রবিবার ১৯শে মে, ২০২৪ ইং ৫ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোর অপরাধ : এক বছরে মামলা বেড়েছে ৩৪%

আকাশবার্তা ডেস্ক :
দেশে কিশোর অপরাধী কী হারে বাড়ছে, তার একটি সাম্প্রতিক তথ্য পুলিশের রেকর্ডকৃত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে কিশোর অপরাধের ঘটনায় সারাদেশে মামলা রেকর্ড হয়েছে এক হাজার ৫৯৬টি। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৮৪টি। এ হিসাবে এক বছরে কিশোর অপরাধের মামলা বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশের বেশি।
বর্তমানে শিশু-কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে আছে ৫৯৮ ও কারাগারে রয়েছে ৩৫ জন। সব মিলিয়ে ৬৩৩ জন কিশোর চার দেয়ালে বন্দি।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম বলেন, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় না হওয়ায় কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। অনেক অভিভাবক সন্তানের আচরণ পরিবর্তনের ব্যাপারে খেয়াল রাখছেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে কিশোররা তাদের বেড়ে ওঠার স্বাভাবিক পরিবেশ পাচ্ছে না।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, কিশোর অপরাধ প্রতিহত করতে র‌্যাবের সব ব্যাটালিয়নকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া আছে। সড়কের দেয়ালে কোনো কিশোর গ্যাং পার্টি সাংকেতিক কিছু লিখছে কি-না সে ব্যাপারেও নজর রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকী বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একার পক্ষে কিশোর অপরাধ রোধ করা সম্ভব নয়। কারণ তারা অনেক সময় আর্থিক লাভ নয়, বরং সামান্য বিষয় নিয়ে রেষারেষির জের ধরে খুনোখুনিতে জড়ায়। অপরাধে সম্পৃক্ত কিশোরদের সুপথে আনতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের ভূমিকা জরুরি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আকাশ-সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে অনেক সময় কিশোরদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। আবার শহরে খেলাধুলার স্বাভাবিক পরিবেশ না থাকা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থাও কিশোর অপরাধ বাড়ার অন্যতম কারণ। অনেক সময় অভিভাবকরা খোঁজ রাখেন না, তাদের সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে। স্কুলে যাচ্ছে কি-না তাও নজরে রাখা দরকার।
অনেকে বলছেন, আমাদের দেশে তরুণরা আগের তুলনায় প্রযুক্তির দিকে অনেক বেশি মনোযোগী। তবে তারা বাঙালি পারিবারিক মূল্যবোধকে অনেক ক্ষেত্রে অগ্রাহ্য করছে। এ ছাড়া যেসব কিশোর এরই মধ্যে অপরাধে যুক্ত হয়েছে তাদের কাউন্সেলিং করানোর মতো ভালো ব্যবস্থা দেশে নেই। তাই তরুণদের মধ্যে একটি অংশ খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়াচ্ছে এবং আরেকটি দল উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে উঠছে। সাধারণত কিশোর-তরুণদের মধ্যে নিজের বীরত্ব দেখানোর প্রবণতা থাকে। প্রায়ই সেটা গুণ্ডামির দিকে চলে যায়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সাধারণত কিশোর অপরাধের তিনটি ধরন দেখা যায়। শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের কিছু বখে যাওয়া সন্তান অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরাধে জড়ায়। তাদের অনেকে রাস্তায় গাড়ির গতি ও শব্দের ঝড় তোলে। অন্যের প্রাণ ঝরায়। আবার কেউ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাদক সেবন করে। নারীঘটিত ব্যাপারেও ঝামেলায় জড়ায়। আবার বস্তি ও নিম্ন আয়ের পরিবারের কিশোররা দারিদ্র্যের কারণে চুরি-ছিনতাই করে ও ক্রমশ বড় অপরাধী হয়। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের কিশোররাও অপরাধে জড়ায়, তবে সংখ্যায় কম।
২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের কোনো ছেলেশিশু অপরাধে জড়ালে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের কিশোর (বালক) উন্নয়ন কেন্দ্রে রাখা হয়। বর্তমানে সেখানে থাকা কিশোরদের মধ্যে ১২০ জন হত্যা মামলার আসামি। ১৪২ জন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত। বাকিরা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ও অস্ত্র মামলায় অভিযুক্ত।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সালে দেশে কিশোর অপরাধের ঘটনায় মোট অভিযুক্তের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ১৭৯ জন। ওই সময়ে কিশোর অপরাধ-সংক্রান্ত এক হাজার ৪২২টি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এতে মোট আসামির সংখ্যা এক হাজার ৮৬৭ জন। ২০১৫ সালে কিশোর অপরাধ-সংক্রান্ত এক হাজার ১৮৪টি মামলায় আসামি ছিল এক হাজার ৭১৯ জন। ২০১৪ সালে মামলা হয়েছে ৮১৮টি, আসামির সংখ্যা এক হাজার ২৬৩। ২০১৩ সালে কিশোর অপরাধের ৫৮৯ মামলায় আসামি ৮৪৮ জন। ২০১২ সালে ৪৮৪ মামলায় আসামির সংখ্যা ৭৫১ জন। বর্তমানে কিশোর অপরাধের ঘটনায় সারাদেশে বিচারাধীন মামলা আছে এক হাজার ২৮২টি। ২০১৬ সালে বিচার নিষ্পন্ন ২৯টি মামলায় খালাস পেয়েছে ৪৭ জন। ছয় মামলায় সাজা হয়েছে সাতজনের। তদন্তাধীন মামলা রয়েছে ১১১টি।
শিশু ও কিশোর সংশোধনী কেন্দ্রে অভিযুক্ত কিশোরের সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১২ সালে সেখানে ছিল ২২৩, ২০১৩ সালে ২৫৯, ২০১৪ সালে ৩০১, ২০১৫ সালে ৪৩৮ এবং ২০১৬ সালে ৫৯৮ জন কিশোর।
চলতি বছরে উত্তরায় বখাটে কিশোরদের ‘ডিসকো বয়েজ’, ‘নাইনস্টার’, ‘বিগবস’ প্রভৃতি নামের গ্রুপের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পরিণামে নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির খুন হলে এ অপরাধপ্রবণতা আলোচনায় আসে। তেজগাঁওয়ের তেজকুনীপাড়ায় সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে খুন হয় আবদুল আজিজ নামের এক কিশোর। রূপনগরে এক স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে একদল কিশোর। এর আগে ২০১৪ সালে মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে মাহিদুল ইসলাম ইমন নামে এক কিশোর গ্রুপদ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে খুন হয়। ২০১৩ সালে কামরাঙ্গীরচরে দুই কিশোরের হাতে আলিফ নামের এক কিশোর এবং লালবাগে রবিন নামের এক কিশোরের ছুরিকাঘাতে আবু সালেহ রাব্বী নামের আরেক কিশোর খুন হয়। গত বছর ভাষানটেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ূয়া এক শিশু ধর্ষণের শিকার হলে ১৪ বছরের এক কিশোরকে আটক করে পুলিশ।
চলতি বছরের শুরুতে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়, স্কুল ড্রেসে কেউ বাইরে অহেতুক ঘোরাঘুরি করলে তাদের আটক করতে হবে। ওই নির্দেশনার পর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অন্তত ৮০০ কিশোরকে আটক করে তাদের অভিভাবকদের জিম্মায় তুলে দেওয়া হয়। পুলিশ বলছে, সতর্ক করতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের পক্ষ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সচেতন করতে সমাবেশের আয়োজন করা হয়।
সূত্র : দৈনিক সমকাল।

     এই বিভাগের আরও সংবাদ

আর্কাইভ

মে ২০২৪
শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
« এপ্রিল    
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১